Header Ads

Header ADS

পাই (π) নিয়ে কিছু কথা |



আজ ১৪ মার্চ। গাণিতিক ধ্রুবক পাই (π)-এর সম্মানে ‘পাই দিবস’ উদযাপনের দিন। পাই-এর মান প্রায় ৩.১৪ বলে প্রতি বছর মার্চ ১৪ (৩/১৪) পাই দিবস হিসাবে পালিত হয়। পাই দিবস কখনও কখনও ১৪ই মার্চ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটে উদযাপন করা হয়। ঐ দিন দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটকে পাই মিনিট নামে আখ্যায়িত করা হয়। দুপুর ১টা ৫৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডকে পাই সেকেন্ড বলা হয়। পাই সেকেন্ডে পাই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে পাইয়ের মানের (৩.১৪১৫৯২৬) কাছাকাছি সময়ে দিবসটি উদযাপন করা সম্ভব হয়। পাই দিবস আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রদানের জন্য সুখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও জন্মদিন। আজ আমরা পাই নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা করবো।

(π)-এর সম্মানে ১৪ মার্চ ‘পাই দিবস’ উদযাপনের দিন

আমাদের আশেপাশের বাস্তব জগতে যত ধরনের জ্যামিতিক বস্তু আছে তার মধ্যে গোলক হল একমাত্র বস্তু যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সৃষ্টি বা প্রাকৃতিক। ত্রিমাত্রিক এই গোলকের দ্বিমাত্রিক রুপ হল বৃত্ত । সুপ্রাচিন কাল হতে মানুষ বৃত্তাকার জিনিসের সাথে পরিচিত। বৃত্তের অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য হল এর পরিধি এবং ব্যাস । বৃত্তের পরিধি কে তার ব্যাস দ্বারা ভাগ করলে একটি ধ্রবক পাওয়া যায়, হোক সে বৃত্ত সুর্যের মত বড় বা একটি মটর দানার মত ছোট । সব সময়ই একই মান । যেটাকে আজ আমরা পাই (π) বলি । প্রাচীন কাল হতেই মানুষ আশ্বর্যহত বৃত্তের এই বিরল বৈশিষ্ট্যের জন্য ।

কিন্তু পাই এর সঠিক মান কত ?

মানব সভ্যতার লিখিত ইতিহাসের শুরু থেকে আজ ও পর্যন্ত মানুষ এই পাই এর মান নির্ণয় করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সমান কৌতুহলে । পেপিরাস হতে জানা যায় আজ হতে প্রায় 4000 বছর আগে প্রাচিন মিশরের মানুষ পাই এর ব্যবহার জানত । তারা পাই এর মান ব্যবহার করত (16/9)2= 3.1605 ।

1900 BC তে প্রাচিন ব্যবিলনে পাই এর মান 3.125 এর প্রমান পাওয়া যায় ।

950 BC তে সুলাইমান (আ: ) তার মন্দির (temple of solomon) নির্মানের সময় পাই এর মান ধরেছিলেন 3 । 800 BC তে লিখিত বাইবেলের দুটি অনুচ্ছেদে (1 kings.7:23 এবং 11 chronicles.4:2) তার প্রমান পাওয়া যায়,

“And he made a molten sea , ten cubits from the one brim to the other , it was round all about.and its height was five cubits , and a line of thirty cubits did compass it about”

(old testament,1 kings.7:23)

এই অনুচ্ছেদ হতে জানা যায় বাইবেল অনুসারে পাই এর মান = 30 কিউবিট/10 কিউবিট = 3।

600BC তে প্রাচিন ইন্ডিয়াতে সংস্কৃত পান্ডুলিপি শতপদ (shatapatha brahmana) তে পাই এর মান দেখা যায় =3.1388 । 250BC তে আর্কমিডিস প্রথম জ্যামিতিক উপায়ে পাই এর মান নির্ণয়ের চেষ্টা করেন । তিনি অবশ্য পাই এর সুনিদ্রিষ্ট মান নির্ণয় না করে গানিতিক অসমতার মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন ।

223/71< π < 22/7

তিনি পাই এর মান নির্ণয়ে এতোই ব্যস্ত ছিলেন যে তার দেশ গ্রিস যে রোমানরা আক্রমন করে দখল করে নিয়েছে তা তার খেয়াল ছিল না । এক রোমান সৈন্য তার ঘরে প্রবেশ করে দেখেন তিনি তখনো পাই নিয়ে গবেষনা করছেন । তিনি রাগত স্বরে সেই সৈন্যকে বলেছেন “Do not disturb my circles”।অতপর সেই সৈন্য তাকে হত্যা করেন । পাই এর মান নির্ণয় করতে করতেই আর্কমিডিসের জীবনাবসান হয়েছিল।

পরবতিতে ত্রিকোনমিতির জনক টলেমি 150 সালে পাই এর মান হিসেবে 3.141666 ব্যবহার করেছেন । অবশ্য তিনি কোন পদ্ধতিতে এই মান পেয়েছেন তা জানা যায় না ।

প্রাচীন চীন, ভারত হয়ে এই পাই এর ধারনা আরব পর্যন্ত পৌছে । ভারতে 500 সালে আর্যভট্র পাই এর মান নির্ণয়ের একটি সূত্র প্রদান করেন

“ add 4 to 100,multiply by 8 and add 62000.the result is approximately the circumference of a circle of which the diameter is 20000”

তার সূত্র মতে পাই এর মান যা আজও আমরা ব্যবহার করি। = (100+4)8+62000 / 20000 =3.1416

পরবর্তীতে ভারতে অবশ্য পাই এর মান হিসেবে π = √10 ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায় । আরবে 800 সালের দিকে বীজগনিতের জনক আল খারেজমী পাই এর মান হিসেবে 3.1416 ব্যবহার শুরু করেন । ফিবোনাক্কি 1220 সালে পাই এর মান হিসেবে 3.141818 ব্যবহার করেন । 1665 সালে স্যার আইজেক নিউটন পাই এর মান নির্ণয় করেন এব্ং দশমিকের পর 16 ঘর পর্যন্ত তিনি আবিষ্কার করেন যা সম্পকে তিনি নিজেই বলেন

“I am ashamed to tell you to how many figures I carried to computations, having not other business at the time”

1706 সালে উইলিয়াম যোনস সর্বপ্রথম পাই এর প্রতিক হিসেবে π ব্যবহার করেন, যা পরবর্তীতে অয়লার ( Leonhard Euler) জনপ্রিয় করে তোলেন । অস্টাদশ শতাব্দির পুর্বেই পাই এর অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার হয়ে যায়। যার প্রথমটি হল পাই হল অমূলদ (Irrational) অর্থা্ত এটিকে কখনো দুটি পুর্ন সংখ্যার ভগ্নাংশ রুপে প্রকাশ করা যাবে না এবং এটি দশমিকের পর অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, খুব সহজ ভাবে এক কথায় বললে বলা যায় আমরা কখনোই পাই এর সঠিক মান নির্ণয় করতে পারব না ,আমাদের শুধু আসন্ন মান নিয়েই সন্তষ্ট থাকতে হবে। পাই এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল এটি ট্রান্সেনডেন্টাল(Transendental)অর্থাত এটি কোন বীজগনিতের সমীকরণের সমাধান হিসেবে লেখা যাবে না । রাদারফোড দশমিকের পর 202 ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করেন । যে সালে রাদারফোড ইলেকট্রন আবিস্কার করেন সেই সালেই পাই নিয়ে সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনা ঘটে আমেরিকায় । এটি গনিতবিদ বিজ্ঞানীদের হাত হতে চলে যায় রাজনীতির খেলার মাঠে ।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের পার্লামেন্ট একটি আইন (২৪৬ নং আইন,১৮৯৭) পাশ করে যে এখন হতে পাই এর মান π=4 । বিশ্বের সবাই পাই এর মান হিসেবে 4 ব্যবহার করবেন নিদ্রিষ্ট টাকা (রয়ালিটি) প্রদান করে,অবশ্য তাদের রাজ্যের পাঠ্যপুস্তকে এটি ফ্রি ব্যবহার করার অনুমুতি থাকবে ।পরে এই আইনটি স্থগিত করা হয়।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট সহজাত গনিতবিদ শ্রিনিভাস রামানুজন 1910সালে পাই এর মান নির্ণয়ের একটি সূত্র আবিস্কার করেন যা পরবর্তীতে কম্পিউটারে পাই নির্ণয়ের সবচেয়ে দ্রুত এলগরিদম হিসেবে আজো ব্যবহার হচ্ছে । 1949 সালে সর্বপ্রথম ইনিয়াক নামক সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে দশমিকের পর 2032 ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করা হয় এবং তার পর পুরোটাই একটা ইতিহাস । গত 16 অক্টোবর , 2011 জাপান দাবী করে তারা দশমিকের পর 10 ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করেছে ।এবং প্রতি মুহুত্বেই একটি রেকর্ড ভেংগে আর একটি রেকর্ড তৈরী হচ্ছে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে 3.1416 এই মানটি যথেষ্ট ।আর মহাজাগতিক সূক্ষ পরীক্ষার জন্য দশমিকের পর 39 ঘর ব্যবহার করে নাসা ও অন্যান্য মহাজাগতিক গবেষনাগার।যাতে আমাদের জানা গ্যালেক্সির আয়তন নির্ণয় করা যায় যাতে ভুলের পরিমান থাকে মাত্র একটি হাইড্রোজেন পরমানুর সমান ।তারপরও মানুষ পাই এর মান নির্ণয় করেই চলেছে এবং তা সম্ভবত মহাবিশ্বের ধংসের পূর্ব পর্যন্ত করেই যাবে । কারন গনিত হল ঈশ্বরের ভাষা যা দিয়ে তিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন ।

তাই তো মহান চিন্তাবিদ র্কাল সাগান তার উপন্যাস “contact” এ উল্লেখ করেছেন যে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির্কতা পাই এর ভেতরে একটি গভীর এবং গোপন বার্তা লুকিয়ে রেখেছেন ।

পাই নিয়ে গল্প লিখা হয়েছে,কবিতা লিখা হয়েছে,তৈরী হয়েছে চলচিত্র । জনপ্রিয় স্টারট্রেক এ শয়তান কম্পিউটারকে বিকল করা সম্ভব হয়েছিল পাই এর সর্বশেষ ডিজিট নির্ণয় করার আদেশ দিয়ে।

পাই এর এই রহ্স্যময় এবং চমকপ্রদ ইতিহাসের জন্যই আমেরিকার MIT সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর মার্চ মাসের 14 তারিখকে “পাই দিবস” হিসেবে পালন করা করে। যা 2009 সালে আমেরিকার হাউস অব রিপ্রেজেনটিভ সমর্থন করেছে । পাই দিবস শুধু পাই এর জন্যই স্মরনীয় নয় । সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জন্মগ্রহন করেছিলেন পাই দিবসে। বাংলাদেশে আমরা কত প্রয়োজনীয়,অপ্রয়োজনীয় দিবস পালন করি ।এ কটি বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনে হয়ত আমরাও একদিন “পাই দিবস” পালন করব অদূর ভবিষ্যতে। অনাগত সেই দিনের অপেক্ষায় সবাইকে আজ “পাই দিবস”এর শুভেচ্ছা।

No comments

Theme images by Matt Vince. Powered by Blogger.